অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত

ভূমিকাঃ


       একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত  হলো উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ।  ইংরেজিতে  দুটি  প্রবাদ  আছে,  'ঞৎধহংঢ়ড়ৎঃ  রং  পরারষরংধঃরড়হদ অর্থাৎ পরিবহনই হলো সভ্যতা এবং  'ঈরারষরংধঃরড়হ সড়াবং ড়হ যিববষদ  অর্থাৎ সভ্যতা চাকার সাহায্যে বিস্তার লাভ করে । বিভিন্ন প্রকার যানবাহনের মাধ্যমে মানুষের চলাচল এবং দ্রব্য বা পণ্য  স্থানান্তর  করাকে  পরিবহন  বুঝায় । অপর  দিকে  যোগাযোগ  হলো  সেসব মাধ্যমের সমষ্টি, যা দেশের  অভ্যন্তরের  এবং দেশের বাহিরের বিভিন্ন ব্যক্তি বা স্থানের সাথে সংবাদ/ তথ্য আদান প্রদানের সম্পর্ক স্থাপন করে । এক কথায়, বিভিন্ন প্রকার যানবাহনের মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্যস্থানে  মানুষ/পন্য  আনা-নেওয়া এবং বিভিন্ন ভাবে সংবাদ/তথ্য  আদান প্রদান কিংবা যাতায়াত করাকে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বলা হয় ।

অর্থনৈতিক উন্নয়নঃ
      অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে এমন এক গতিধারাকে নির্দেশ করে, যা কতগুলো অর্থনৈতিক শক্তির  সংযোগ  যার  মাধ্যমে জনগনের  মাথাপিছু  আয়  ক্রমাগত বৃদ্ধি  পায়  । এ  প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ  সি. ই. ব্লাক  ‘ঞযব ফুহধসরপং  ড়ভ  সড়ফবৎহরুধঃরড়হ,  গ্রন্থে  বলেন,   “ উৎপাদন  শীলতা  বৃদ্ধি, আর্থ-সামাজিক  সাম্য, আধুনিক  জ্ঞান-বিজ্ঞান, উন্নত  প্রতিষ্ঠান ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজ ব্যবস্থায় বিরাজমান অনাকাক্সিক্ষত অবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে গৃহীত যুক্তিযুক্ত সমন্বিত নীতি পদ্ধতির  মাধ্যমে অর্জিত আধুনিকায়নকে  অর্থনৈতিক উন্নয়ন হিসাবে গণ্য  করা যায় ”। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মিল্টন ফ্রিডম্যানের মতে, ঊপড়হড়সরপ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ রং ধহ রহহড়াধঃরাব ঢ়ৎড়পবংং ষবধফরহম ঃড় ঃযব ংঃৎঁপঃঁৎধষ ঃৎধহংভড়ৎসধঃরড়হ ড়ভ ংড়পরধষ ংুংঃবস."   । তাই বলা  যায়,  অর্থনৈতিক  উন্নয়ন  কোন দেশের উৎপাদন  বৃদ্ধি, আর্থসামাজিক অগ্রগতি, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার, প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি, দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা, সরকারি কর্মকান্ড  ও  নীতিসমূহের  সমন্বিত  বাস্তবায়ন  প্রভৃতি  নির্দেশ  করে । 
বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থাঃ
     পরিবহন ব্যবস্থা বলতে পরিবহন ব্যবস্থায় নিয়োজিত যানবাহনের সাহায্যে বিভিন্ন মালামাল পরিবহন এবং জনগণ একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে যাতায়াত করাকে বুঝায় । 
পৃথিবীর সকল দেশে প্রধানত চার ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায় । যথাঃ
     ১. রেলপথ, 
     ২.সড়কপথ,
     ৩. জলপথ এবং
     ৪. আকাশপথ ।  
রেলপথে রেলগাড়ির সাহায্যে মালামাল ও যাত্রী  পরিবহনের কাজ চলে । সড়ক পথে মোটরগাড়ি, ট্রাক,বাস,লরি,ট্যাক্সি, রিকশা, সাইকেল প্রভৃতি যানবাহন চলাচল করে । এছাড়া আমাদের দেশে গরুর গাড়ি ও ঠেলাগাড়িরও প্রচলন রয়েছে । জলপথে মালামাল ও যাত্রী পরিবহনের কাজে নৌকা, সাম্পান,স্পীডবোট, স্টিমার,লঞ্চ, ফেরি ইত্যাদি চলে । বিমান পথে বিমান যোগে মালামাল ও যাত্রী পরিবহনের কাজে পরিচালিত হয় ।
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ
      যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে সেসব মাধ্যমের সমষ্টিকে বুঝায়, যেসব মাধ্যম দেশের অভ্যন্তরে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশের সাথে তথ্য আদান প্রদানে সহায়তা করে । যোগাযোগ  ব্যবস্থার সাহায্যে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় ও বিভিন্ন ব্যাক্তির সাথে যেমন যোগাযোগ রক্ষা করা যায় । তেমনি বিদেশেও বিভিন্ন জায়গা ও বিভিন্ন ব্যাক্তির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয় । যোগাযোগ ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য মাধ্যম গুলো হলো ডাক বিভাগ, টেলিগ্রাফ,টেলিফোন,মোবাইল,বেতার,টেলিভিশন,ভূ-উপগ্রহ, টেলেক্স, ফ্যাক্স, ই-মেইল প্রভৃতি । যোগাযোগ ব্যবস্থায় আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে  আসছে  ।
বাংলাদেশের রেলপথঃ
          বাংলাদেশে রেলপথের সূচনা করে ব্রিটিশ রেলওয়ে কোম্পানি । ১৮৬২ সালে দর্শনা থেকে  জগতি পর্য়ন্ত মাত্র ৫২.৮ কিলোমিটার পথ নিয়ে রেলপথের যাত্রা শুরু হয় । এরপর বিভিন্ন সময়ে রেলপথের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত রেলপথের দৈর্ঘ্য দাড়ায় ৩৪০০ কিলোমিটার । স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এদেশের রেলওয়ের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয় এবং প্রায় ১৫০০ দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রাণ হারায় । এরই প্রেক্ষিতে দেশের রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণ করে । এর মধ্যে  উল্ল্যেখযোগ্য হলো ৩০০টি রেলসেতু পুননির্মান ও মেরামত ইঞ্জিন, বগী, মালবাহী ওয়াগন, নতুন প্লাটফর্ম মেরামত, সিগন্যাল পদ্ধতি স্থাপন,বিদ্যুতায়, যাত্রী ছাউনি নির্মানসহ আরো অনেক প্রকল্প পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হয় । বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় রেলপথেরে দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৩৫ কিলোমিটার । এরমধ্যে ৬৫৯ কিলোমিটার ব্রডগেজ,৩৭৫ কিলোমিটার গেজ । ২০০৩ সালে বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলে জামতৈল হতে পশ্চিমাঞ্চলের জয়দেবপুর পর্যন্ত সরাসরি রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । ২০০৪-০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ের অধীন মোট ২৭৩টি ডিজেল ইঞ্জিন, ১৩৪৭টি যাত্রীবাহী কোচ, ১০,৩২৮টি মালবাহী  ওয়াগন এবং ৬৪টি অন্যান্য কোচ রয়েছে । এছাড়া ৩২৬ কিলোমিটার নতুন ব্রডগেজ লাইন নির্মান ও ৯টি মিটারগেজ লোকমেটিভ এবং যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহের উদ্দ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।২০০৮ সালের বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন হতে ‘‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’’ নামে রেলগাড়ির শুভাগমনের মধ্যে দিয়ে ঢাকা - কলকাতা রেল সার্ভিস চালু করা হয় ।  বর্তমানে ২০১৩ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী  বাংলাদেশের রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য  ২৮৭৭ কিলোমিটার । 

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                 


বাংলাদেশের রেলপথের প্রধান প্রধান নাম নি¤েœ উল্লেখ করা হলঃ-

১. ঢাকা - চট্টগ্রাম রেলপথ ।
২. ঢাকা - সিলেট রেলপথ ।
৩. পার্বতীপুর - ঈশ্বরদী - পোড়াদহ - খুলনা রেলপথ
     ইত্যাদি  ।

বাংলাদেশের সড়ক পথঃ


        যে কোন দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সড়ক ও সড়ক পরিবহন খাতের  ভূমিকা  অনস্বীকার্য ।  যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের দিক থেকে অন্যান্য পরিবহন ব্যবস্থার তুলনায় সড়ক পরিবহনই সর্বাধিক ব্যবহৃত মাধ্যম । এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্থল পরিবহনের মধ্যে সড়ক পরিবহন শতকরা  ৭৩ ভাগের অধিক যাত্রী এবং ৬৩ ভাগের অধিক মালামাল পরিবহন করে । বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণীর মোট প্রায় ২১,৩৬৫ কিঃমিঃ সড়ক ও সড়ক জনপদ রয়েছে । তার মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক ৩,৫৮০ কিঃমিঃ, আঞ্চলিক মহাসড়ক ৪,২৭৬ কিঃমিঃ ফিডার বা জেলা সড়ক ১৩,৫০৯ কিঃমিঃ । 

নি¤েœ বাংলাদেশের কতক গুলো গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পথের নাম দেওয়া হলো:
১. ঢাকা - কুমিল্লা - চট্টগ্রাম - কক্সবাজার  ।
২. ঢাকা - যশোর - খুলনা ।
৩. রাজশাহী - নাটোর ।
৪.বাগমারা-রাজশাহী ।

বাংলাদেশ সওজ অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন শ্রেণীর সড়ক পথের বিবরণ নি¤েœর তালিকায় দেওয়া  হলোঃ
অর্থবছর    জাতীয় মহাসড়ক    আঞ্চলিক  মহাসড়ক    জেলা রোড    মোট
২০০১    ৩০৮৬    ১৭৫১    ১৫৯৬২    ২০৭৯৯
২০০২    ৩০৮৬    ১৭৫১    ১৫৯৬২    ২০৭৯৯
২০০৩    ৩০৮৬    ১৭৫১    ১৫৯৬২    ২০৭৯৯
২০০৪    ৩০৮৬    ১৭৫১    ১৫৯৬২    ২০৭৯৯
২০০৫    ৩৫২৯    ৪১২৭    ১৩১২৬    ২০৭৮২
২০০৬    ৩৫২৯    ৪১২৭    ১৩১২৬    ২০৭৮২
২০০৭    ৩৪৮২    ৪১২৮    ১৩২৫৫    ২০৮৬৫
২০০৮    ৩৪৭৮    ৪০০৪    ১৩৫১৩    ২০৯৯৫
২০০৯    ৩৪৯২    ৪২৫৩    ১৩২৭৫    ২১০২০
২০১০    ৩৫৩৮    ৪২৭৬    ১৩৪৫৫    ২১২৬৯
২০১১    ৩৫৩৮    ৪২৭৬    ১৩৪৭০    ২১২৮৪
২০১২    ৩৫৩৮    ৪২৭৬    ১৩৫০৯    ২১৩২৩
২০১৩    ৩৫৮০    ৪২৭৬    ১৩৫০৯    ২১৩৬৫
 
উংসঃ সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর

বাংলাদেশের নৌপথঃ 

 


    নদীমাতৃক বাংলাদেশে পরিবহন ও যাতায়াতের অন্যতম প্রধান একটি মাধ্যম হলো নৌপথ । আমাদের  পরিবহন ও যাতায়াতের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ নৌপথে সম্পন্ন হয় । বাংলাদেশের সারাবছর নৌ চলাচলের উপযোগী স্থায়ী জলপথের পরিমাণ হলো ৫,৪২১ কিঃমিঃ যা বর্ষা মৌসুমে বৃদ্ধি পেয়ে ৮,৪৩৯ কিঃমিঃ এ উন্নীত হয় । নৌপথের বাহন গুলো নৌকা, সাম্পান,স্পীডবোট, স্টিমার,লঞ্চ, ফেরি ইত্যাদি । দেশের নৌপথের  উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ,পন্য পরিবহন ইত্যাদির স্বার্থে সরকার বেশ কয়েকটি সংস্থা গড়ে তুলেছে । যেমন- বাংলাদেশ  শিপিং কর্পোরেশন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (ইওডঞঅ),  বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশন  (ইওডঞঈ), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর ইত্যাদি ।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের মোট জলযান ১৯৫ টি ।এরমধ্যে ১৪২ টি বাণিজ্যিক যান ও ৫৩ টি সহায়ক জলযান । সমুদ্র পথে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন পণ্য আমদানি করে থাকে । এ সংস্থার ১৩ টি জাহাজ আছে । এরমধ্যে ১০ টি সাধারণ পন্যবাহী ও ১ টি কন্টেইনারবাহী ও ২টি লাইটারেজ ট্যাকার । অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্রোপরেশনের ১৮৯ টি জলযান দ্বারা নাগরিক সেবা প্রদান করছে । 
বাংলাদেশের  মোট ২টি সমুদ্র বন্দর হলঃ
১. মংলা সমুদ্র বন্দর ।
২. চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ।


বাংলাদেশের  প্রধান প্রধান নৌ বন্দর এর নাম নি¤েœ উল্লেখ করা হলঃ-
৩. চাঁদপুর নদী বন্দর ।
৪. ঢাকা নদী বন্দর ।
৫. নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর ।
৬. বরিশাল নদী বন্দর ।
৭. ভোলা নদী বন্দর ।
৮. খুলনা নদী বন্দর ইত্যাদি ।
 

আপনি ও পছন্দ করতে পারেন