সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা

   প্রথম অধ্যায়

ভূমিকা
পৃথিবীর সূচনা লগ্নে আদিম সমাজের মানুষ একাকী বসবাস করত । সেখানে রাষ্ট্রের কোন অস্তিত্ব ছিল না । একসময় মানুষ দলগত ভাবে বসবাস করতে শুরু করে । এরপরে সময়ের ক্রমবিবর্তনে মানুষ পরিবার, গোষ্ঠী, সমাজ গড়ে তুলে । পরবর্তীতে পরিবার, গোষ্ঠী, সমাজের সমন্বয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় । রাষ্ট্রের সৃষ্টির পরে রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন শাসন পদ্ধতির প্রচলন ঘটে । শাসন পদ্ধতি গুলো ছিল রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র,একনায়কতন্ত্র ও গনতন্ত্র । জনগনের শাসন হিসাবে খ্যাত গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা আধুনিক বিশে^ খুবই জনপ্রিয় ও সমাদৃত । শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের সম্পর্কের ভিত্তিতে গনতান্ত্রিক সরকারকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যায় । যেমন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার  ও সংসদীয় সরকার । যে সরকার ব্যবস্থায় শাসন বিভাগ তাদের কাজের জন্য আইন সভার নিকট দায়ী থাকে তাকে মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার বা সংসদীয় সরকার বলা হয় । অধ্যাপক গার্নার বলেন,
                       
                    
   ২য় অধ্যায়

তাত্ত্বিক কাঠামো 
      যে শাসন ব্যবন্থায় মন্ত্রীপরিষদ তার কার্যকলাপের জন্য আইন বিভাগের নিকট  দায়ী থাকে তাকে মন্ত্রীপরিষদ  বা সংসদীয় সরকার বলে । এই সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রীসভা প্রকৃত ক্ষমতার মালিক মন্ত্রীসভাই প্রকৃত কর্ণধার বা প্রকৃত শাসক । সমস্ত ক্ষমতা মন্ত্রী সভার হাতে ন্যস্ত থাকে  । মন্ত্রীসভার শীর্ষে একজন প্রধানমন্ত্রী থাকেন । 
 তার নেতৃত্ত্বেই মন্ত্রীসভা গঠিত হয় । তিনি মন্ত্রীসভার কেন্দ্র বিন্দু । তাকে ঘিরেই মন্ত্রীসভা   আবর্তিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় । তিনি মন্ত্রীসভার প্রাণ প্রদীপ । 
এ শাসন ব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতা তত্ত্বগতভাবে একজন রাজা বা রাষ্ট্রপতির নিকট ন্যস্ত থাকে । রাজা বা রাষ্ট্রপতি হলেন নামসর্বস্ব বা অলংকারিক রাষ্ট্রপ্রধান। ( ঞরঃঁষধৎ যবধফ ড়ৎ হড়সরহধষ  বীবপঁঃরাব )  । তিনি প্রকৃত  ক্ষমতা চর্চা করেন না ।
 তার নামেই শাসনকার্য পরিচালিত হয় ; কিন্তু রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা মন্ত্রীপরিষদ এর হাতে ন্যস্ত থাকে ।
  এ ক্ষেত্রে রাজা বা রাষ্ট্রপতি নাম মাত্র শাসকের ভূমিকা পালন করে । মন্ত্রীসভা   ব্যাক্তিগত ও যৌথভাবে তাদের কাজের জন্য আইন সভার নিকট দায়ী থাকে । 
এই ব্যবস্থায় মন্ত্রীসভা  তাদের কার্য ও কার্যনীতির জন্য আইন সভার নিকট দায়ী থাকে বলে একে দায়িত্বশীল সরকার এবং এব্যবস্থায় মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ আইন সভার সদস্য বিধায় ও এই সরকার আইন সভার প্রাধান্য থাকে । আইনসভা সরকারকে নিয়ন্ত্রন করে বলে একে সংসদীয় সরকার বলা হয় । 

     নি¤েœ সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার কয়েকটি সংজ্ঞা  উল্লেখ করা হলঃ 

অধ্যাপক হারম্যান ফাইনার বলেন
 মন্ত্রীপরিষদ হচ্ছে স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত এমন এক সংস্থা, যার সদস্য বৃন্দ আইন সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা দল সমূহের মধ্য থেকে নিয়োগ লাভ করেন এবং যারা সচরাচার ঐ সংস্থারই সদস্য এবং আইন সভার আস্থা লাভ সাপেক্ষে ক্ষমতাসীন থাকেন এবং ক্ষমতা কার্যকর করেন ।’’

অধ্যাপক গার্নার এর মতে, মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার এমন এক ধরনের শাসন ব্যবস্থা যেখানে প্রকৃত শাসক বা মন্ত্রীপরিষদ তার রাজনৈতিক কার্যাবলির জন্য প্রত্যক্ষ ও আইন সংগত ভাবে আইন সভা বা এর একটি কক্ষের নিকট দায়ী থাকে এবং অবশেষে নির্বাচক মন্ডলীর নিকট দায়ী থাকে ।

 

পরিশেষে বলা যায় যে,সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা হলো এমন এক ধরনের শাসন ব্যবস্থা যেখানে মন্ত্রীপরিষদ প্রকৃত ক্ষমতা চর্চা করে ও তার কার্যাবলীর জন্য আইন সভার নিকট দায়ী থাকে এবং রাষ্ট্রপতি অলংকারিক  বা নাম মাত্র প্রধান ।
 বাংলাদেশ, ভারত,যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশে মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান ।                  

       ৩য় অধ্যায়

সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ 
                   প্রত্যেকটির কাজের কিছু না কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে । তেমনি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে । নি¤েœ সেগুলো আলোচনা করা হলঃ
                  

১.গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় রাখাঃ
          সংসদীয় সরকারের অন্যতম একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় রাখা  । এ শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীসভা হলো প্রকৃত শাসক । এখানে জনগনের প্রতিনিধিদের দ্বারাই সরকারী নীতি নির্ধারিত হয় এবং শাসন কার্য পরিচালিত হয় । জনগনের প্রতিনিধি পুষ্ট আইন সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের অবিমত প্রতিফলন হয় । সরকার এই অভিমতকে  উপেক্ষা করতে পারে না ।

২.স্বৈরাচারিতা প্রতিরোধঃ
        সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য হলো স্বৈরাচারী শাসনকে প্রতিহত করা । এ শাসন ব্যবস্থায় সরকার নিজে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আইন সভার উপর নির্ভর করে ।  এখানে বিরোধীদল সরকারের দোষ ত্রুটি অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকে । যদি ক্ষমতাসীন দল তথা সরকার স্বৈরাচারী হতে চায় তাহলে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে তা হতে পারে না । যা একমাত্র সংসদীয় সরকারেরই সম্ভব ।

৩. রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসারঃ
          সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার আরেকটি লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো । কারন এ সরকার দলীয় সরকার  । এখানে সরকারী দল ও বিরোধীদল জনমত সংগ্রহের জন্য সবসময় তৎপর থাকে । ফলে দলীয় প্রচার, প্রচারনা ও দলীয় কর্মকান্ড সর্বদা অব্যাহত থাকে বিধায় জনগন রাজনৈতিক কর্মকান্ড সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে এবং তাদের রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটে ।   

৪. জনকল্যাণঃ 
    সংসদীয় সরকার বা মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার একটি জনকল্যাণ মূলক সরকারও বটে । তাই এই সরকার ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জনকল্যান সাধন করা । এই শাসন ব্যবস্থায়  সরকার সকল কাজ জনগনের কল্যাণের জন্য করে থাকে । 

৫. সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাঃ 
সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য । এই ধরনের  সরকার ব্যবস্থায় সরকার জনগনের সম্মতি নিয়ে তাদের জান মাল স্বাধীনতা প্রভৃতি রক্ষা ও সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে ।

৬. দেশের শাস্তি শৃংখলা বজায় রাখাঃ
        সংসদীয় সরকার দেশের মধ্যে  শাস্তি শৃংখলা বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করে । কেননা যদি কোন দেশে শাস্তি শৃংখলা বজায় রাখা না থাকে তাহলে সে দেশের উন্নতি করা সম্ভব হয় না । 
তাই সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় দেশের মধ্যে সরকার শাস্তি শৃংখলা বজায় রাখার জন্য সচেষ্ট থাকে ।

৭. দারিদ্র ও শোষনের অবসানঃ
         অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য বা ধনী দরিদ্রের  মধ্যে দুস্তর ব্যবধান সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার সাফল্যের বিরোধী এবং  ধনবৈষ্যম্য মূলক সমাজ ব্যবস্থায় দারিদ্র পীড়িত সাধারন মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকে না । 
তাই এই শাসন ব্যবস্থায় সরকার  দারিদ্র বিমোচন, ধন বৈষম্য, দূর করন, অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে কাজ করে ।

৮. আমলা তান্ত্রিক জটিলতা হ্্রাসঃ
          আমলা তান্ত্রিক জটিলতা হ্্রাস সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার প্রসারে বাধা হিসাবে কাজ করে । কারণ আমলা তান্ত্রিক জটিলতার জন্য প্রশাসনিক কার্জ প্রক্রিয়ায় গতিশীলতা ব্যাহত ।
 তাই সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় আমলা তান্ত্রিক জটিলতা হ্্রাস করা হয় ।

৯. জনগনের মৌলিক  অধিকার সংরক্ষনঃ
              দেশের জনগনের মৌলিক  অধিকার সংরক্ষন সংসদীয় সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব । সরকার কোন ভাবেই এই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না । 
জনগনের  মৌলিক  অধিকার খর্ব হলে জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে । এরূপ অবস্থায় সরকারকে বিপাকে পড়তে হয় । 


১০. সুষ্ঠ,অবাধ,নিরপেক্ষ নির্বাচনঃ
           রাজনীতিকে কলুষ মুক্ত রাখার মাধ্যম হলো নির্বাচন । এই নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠ, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন । সুষ্ঠ নির্বাচন না হলে দেশে রাজনৈতিক সংকট ঘণীভূত হয় । 
এই সংকটে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে । সংসদীয় সরকারের পতন ঘটে । তাই সুষ্ঠ,অবাধ,নিরপেক্ষ নির্বাচন এর প্রয়োজন ।
 

আপনি ও পছন্দ করতে পারেন