অর্থনৈতিক উন্নয়নে রপ্তানি খাতের ভূমিকা পার্ট-১

                        তৃতীয় অধ্যায় 


অর্থনৈতিক উন্নয়নঃ
      অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে এমন এক গতিধারাকে নির্দেশ করে, যা কতগুলো অর্থনৈতিক শক্তির  সংযোগ  যার  মাধ্যমে জনগনের  মাথাপিছু  আয়  ক্রমাগত বৃদ্ধি  পায়  । এ  প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ  সি. ই. ব্লাক  ‘ঞযব ফুহধসরপং  ড়ভ  সড়ফবৎহরুধঃরড়হ,  গ্রন্থে  বলেন,   “ উৎপাদন  শীলতা  বৃদ্ধি, আর্থ-সামাজিক  সাম্য, আধুনিক  জ্ঞান-বিজ্ঞান, উন্নত  প্রতিষ্ঠান ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজ ব্যবস্থায় বিরাজমান অনাকাক্সিক্ষত অবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে গৃহীত যুক্তিযুক্ত সমন্বিত নীতি পদ্ধতির  মাধ্যমে অর্জিত আধুনিকায়নকে  অর্থনৈতিক উন্নয়ন হিসাবে গণ্য  করা যায় ”। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মিল্টন ফ্রিডম্যানের মতে, ঊপড়হড়সরপ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ রং ধহ রহহড়াধঃরাব ঢ়ৎড়পবংং ষবধফরহম ঃড় ঃযব ংঃৎঁপঃঁৎধষ ঃৎধহংভড়ৎসধঃরড়হ ড়ভ ংড়পরধষ ংুংঃবস."   । তাই বলা  যায়,  অর্থনৈতিক  উন্নয়ন  কোন দেশের উৎপাদন  বৃদ্ধি, আর্থসামাজিক অগ্রগতি, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার, প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি, দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা, সরকারি কর্মকান্ড  ও  নীতিসমূহের  সমন্বিত  বাস্তবায়ন  প্রভৃতি  নির্দেশ  করে । 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদানসমূহ:
              অধ্যাপক আরটি গিল  অর্থনৈতিক উন্নতির বিভিন্ন পূর্ব শর্ত বিশদভাবে আলোচনা করেছেন । তিনি এ ব্যাপারে বলেন কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাতটি উপাদানের কথা উল্ল্যেখ করেছেন ।


উৎপাদন সংগঠনঃ
                উন্নয়নের জন্য ভূমি শ্রম মূলধন ও সংগঠন পরিকল্পিত ভাবে সংগ্রহ করতে হবে। এদের সংগঠিত করলে দ্রব্য বা সম্পদ উৎপন্ন হতে পারে । এই চারটি উপাদনের সংমিশ্রণ হতে সমস্ত দ্রব্য উৎপাদন হয় । ঠিক কোন ধরণের ইনপুট সংমিশ্রণ ব্যবহার হবে সেটি নানা বিষয় চিন্তা করে উদ্যোক্তারা স্থির করে ।   কিন্তু উৎপাদন সংগঠন সর্বদা উন্নত করে তোলার অপর নাম অর্থনৈতিক উন্নয়ন ।
 
প্রাকৃতিক সম্পদঃ
প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলে উৎপাদন বাড়ে না, উন্নয়নও হয় না । প্রাকৃতিক সম্পদ এর মূল উপকরণ । এরাই উৎপাদনের মূল ভিত্তি । প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি থাকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া কেউ এত বেশি উন্নত হতে পারত না ।
   
মূলধন সংগ্রহঃ 
       উন্নয়নের মূল কথা মূলধন সংগ্রহ । উপকরণকে সঠিকভাবে পরিবর্তিত করে শ্রম  । আনেক নিপুন যন্ত্রপাতির সাহায্যের দরকার হয় ।  এ ধরনের মূলধন না থাকলে উৎপাদন কম হয় । অর্থাৎ শ্রম অনেক কম উৎপাদনশীল থাকে । 

উৎপাদনের বিশেষীকরণঃ
           উন্নয়নের জন্য দরকার অধিক মাত্রায় উৎপাদন যাতে বৃহদায়তন উৎপাদনের বিশেষীকরণ ব্যয় সুবিধা পাওয়া যায় । বেশি উৎপাদন হলে বিশেষীকরণ হয় । ফলে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় ।  তাই রপ্তানির জন্য উৎপাদনের বিশেষীকরণ প্রয়োজন ।


উদ্যোগঃ
         পশ্চিমা উন্নত দেশ গুলোতে ব্যক্তিগত উদ্যোগ উন্নয়নে দায়িত্ব পালন করে । কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক কারণে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি রাষ্ট্রিয় উদ্যোগের প্রয়োজন । 

উন্নত অবকাঠামোঃ
              উন্নত পরিবহন, যাতায়াত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত বলা যায় । কারণ এগুলো দ্রব্যের উৎপাদন এবং বিক্রয় বা বন্টন ব্যয় হ্রাস করে  উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করতে পারে । 
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাঃ
          অব্যাহত অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা । রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে উন্নয়ন কর্মকান্ড ও গতিশীলতা বৃদ্ধি পায় । রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা, দূর্নীতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদির জন্ম দেয় ।       
লাগসাই শিক্ষা ব্যবস্থাঃ
      শিক্ষা ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি প্রধান উপাদান । যে সমাজ যত শিক্ষিত  সে সমাজ তত উন্নত । এছাড়া কারিগরী শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে দক্ষ শ্রমিক হতে সাহায্য করে । এসব কিছু উন্নয়নের উপাদান বলা হয় । 
                              চতুর্থ অধ্যায়

বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের উদ্দ্যেশ্যসমূহ :
                        বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ততটা উন্নত নয়। বিভিন্ন উদ্দ্যেশ্যে এদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য সংগঠিত হয়ে থাকে । নিম্নে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের উদ্দ্যেশ্যসমূহ আলোচনা করা হলো :-
১. উদ্বৃত্ত পণ্যসামগ্রী রপ্তানি :    
                এদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান উদ্দ্যেশ্য হলো উদ্বৃত্ত পণ্য সামগ্রী রপ্তানি করা। এতে দেশে শিল্পের বিকাশ ঘটে ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। বাংলাদেশ পাট, চা, চামড়া, চিংড়ি, তৈরি পোষাক ইত্যাদির অভ্যান্তরীন চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে থাকে।

২. যন্ত্রপাতি ও কাচাঁমাল আমদানি :
                        এদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম উদ্দ্যেশ্য হলো দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যন্ত্রপাতি ও কাচাঁমাল আমদানি করা। আমাদের দেশের কৃষি, শিল্প, ও পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং বিভিন্ন শিল্পের কাচাঁমাল বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে আমদানি করা হয়। এগুলো দ্বারা নিজ দেশের প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করে নিজের চাহিদা মিটানো হয়। এভাবে নিজ দেশের শিল্পের বিকাশ সাধন করা সম্ভব। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।

৩.অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি :
                        আমাদের খাদ্যদ্রব্য ছাড়াও অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্যের অভাব রয়েছে। আমদানির মাধ্যমে সে অভাব পূরণ করা সম্ভব। কোন দেশই খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। যে দেশ পণ্য উৎপাদন করতে পারেনা, সে দেশ সেই পণ্য আমদানি করে  চাহিদা  মিটাতে পারে। আর বৈদেশিক বাণ্যিজ্যের দ্বারাই এটি সম্ভব।
৪. দেশীয় পণ্যের বাজার সৃষ্টি :
                বিদেশে পণ্যের বাজার সৃষ্টি করাও বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের  অন্যতম উদ্দ্যেশ্য। বৈদেশিক বাণিজ্যের দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়। কেননা পণ্য বিনিময়ের সুযোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য পরিচিতি লাভ করে। এতে বিদেশে নিজ দেশের পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে পণ্যের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।

৫. রপ্তানি বৃদ্ধি করা :
                বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি জনপদ। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরণের শিল্পপণ্য উৎপাদন করে দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি করার প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও  যথাযথ শিল্পায়নের অভাবে অধিকাংশ প্রাকৃতিক সম্পদ অব্যবহৃত থেকে যায়। এমতাবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যেগে বিভিন্ন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি করা বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম উদ্দ্যেশ্য।

৬. আমদানি-বিকল্প শিল্পস্থাপনে উৎসাহিত করা :
                  বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য মূলত আমদানি নির্ভর। আমদানি নির্ভরশীলতার কারণে এদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবসময়ই প্রতিকূলতা বিরাজমান। এমতাবস্থায় বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে পর্যাপ্ত পরিমানে আমদানি-বিকল্প শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত করা বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি অন্যতম উদ্দ্যেশ্য। 

৭. প্রচলিত পণ্যের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি :
                বাংলাদেশে উৎপাদিত এমন অনেক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পজাত পণ্য আছে , যে গুলো প্রচলিত পণ্য হিসেবে স্বীকৃত। দেশের অভ্যান্তরীন বাজার ছাড়িয়ে বিদেশেও এগুলোর বেশ চাহিদা রয়েছে। এমতাবস্থায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বাণিজ্য মেলায় অংশ গ্রহনের ব্যবস্থা করে এসব প্রচলিত পণ্যের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করণ বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দ্যেশ্য।

৮. অপ্রচলিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি ঃ
                বাংলাদেশে উৎপাদিত এমন অনেক পণ্য আছে যেগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহারোপযোগীতা থাকলেও যথাযথ প্রচার ও পরিচিতির অভাবে অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে চিহ্নিত। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এসব অপ্রচলিত পণ্যের যথাযথ প্রচার ও পরিচিতির ব্যবস্থা করে বিদেশে এগুলোর বাজার সৃষ্টি করণ বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দ্যেশ্য।


৯. জনশক্তি রপ্তানি :
                বাংলাদেশ বিশ্বের জনবহূল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। পর্যাপ্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের অভাবে এদেশের দক্ষ ও আদা-দক্ষ শ্রমিকের একটি বিরাট অংশ বেকার থেকে যাচ্ছে। এমতাবস্থায়  বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে এসব শ্রমিকের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম উদ্দ্যেশ্য।
১০. পণ্যের মান উন্নত করা :
                বর্তমানকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান প্রচুর সংখ্যক সমজাতীয় পণ্য উৎপাদন করে থাকে। ফলে বাজারে সবসময় তীব্র প্রতিযোগীতা বিরাজ করে। এমতাবস্থায় প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার জন্য পণ্যের মানোন্নয়ন ছাড়া গতান্তর নেই। সুতরাং পণ্যের মান উন্নত করাও বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যর একটি উদ্দ্যেশ্য।

১১. ক্ষুদ্র ও কুটি শিল্পের উন্নয়ন :
                        বাংলাদেশে উৎপাদিত এমন অনেক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পজাত দ্রব্য রয়েছে যেগুলোর দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ছাড়িয়ে বিদেশের বাজারেও বেশ চাহিদা রয়েছে। দেশের এসব ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পজাত দ্রব্য সামগ্রীর মাধ্যমে রপ্তানি বাজারকে সম্প্রসারিত করাসহ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন ঘটানো বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম উদ্দ্যেশ্য।
 

আপনি ও পছন্দ করতে পারেন