সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা পার্ট-২

    ৬ষ্ঠ অধ্যায়
সংসদীয় সরকার বা মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকারের দোষাবলিঃ
মন্ত্রী পরিষদ শাসিত শাসন ব্যবস্থা উত্তম শাসন ব্যবস্থা বটে । কিন্তু দোষও কম নয় । নি¤েœ এর দোষসমূহ তুলে ধরা হলঃ

১.    ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পরিপন্থীঃ
                 মন্ত্রীপরিষদ শাসিত শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রী করণ নীতির প্রয়োগ হয় না । এতে আইন বিভাগ শাসন বিভাগ উভয়ে পরস্পরের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে ।  বিচার বিভাগের কাজও শাসন বিভাগ হস্তক্ষেপ করে থাকে । 

২.জরুরী অবস্থার অনুপযোগীঃ
         এ ধরনের  শাসন ব্যবস্থায় সরকারী সকল সিদ্ধান্ত মন্ত্রীসভার বৈঠকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে গৃহিত হয় । সেই জন্য কোন বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহন করা যায় না । এর ফলে বহিরাক্রমণ অভ্যন্তরীণ গোলযোগ প্রভৃতিতে দেশ বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে।

৩. দল ব্যবস্থার ত্রুটিঃ
         এই শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য । ফলে এধরনের দল ব্যবস্থার সব ত্রুটি লক্ষ্যনীয় । সরকারের দোষ ত্রুটি সমালোচনার পরিবর্তে সর্ব ক্ষেত্রে সরকারের বিরোধিতা করাই বিরোধী দলের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় । 

৪. দূর্বল ও অস্থায়ী সরকারঃ
         এ ব্যবস্থায় একাধিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি অপরিহার্য । কিন্তু দেশে বহুদল ব্যবস্থা থাকলে এই সরকারের দূর্বল হওয়ার আশংকা থাকে । ফলে এরূপ মন্ত্রীসভা কখনই জনকল্যাণ সাধনে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বা জনসেবায় আতœনিয়োগ করতে পারে  না ।

৫. অযোগ্য ব্যাক্তিদের শাসনঃ
            এ শাসন ব্যবস্থায় আইন সভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও প্রধান্যের কথা কথা কলা হয় ; কিন্তু যে সকল জনপ্রতিনিধি  আইন সভার সদস্যপদ লাভ করেন তার গুণগত যোগত্যার ভিত্তিতে নির্বাচিত হন না । 
এতে আইন সভার বহু অযোগ্য, অদক্ষ ও অসৎ ব্যাক্তি স্থান পায় । ফলে এই  ব্যবস্থা অযোগ্যদের শাসনে পরিণত  হয় ।    


               ৭ম অধ্যায়
সংসদীয় সরকারের সফলতার শর্তাবলিঃ
               সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা একটি কল্যাণমূলক শাসন ব্যবস্থা । কিন্তু বর্তমান পেক্ষাপটে এ ব্যবস্থাকে সাফল্য মন্ডিত করতে বেশ কিছু  শর্ত পূরণ করতে হয় ।  সেগুলো আলোচনা করা হলো ।

১. নিয়ম তান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রধানঃ
                সংসদীয় সরকার এর  সফলতার জন্য একটি নিয়ম তান্ত্রিক বা উপাধি সর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান থাকা আবশ্যক । শাসন ক্ষমতা সংবিধান অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক ভাবে তার নিকট ন্যাস্ত থাকলেও প্রকৃত ক্ষমতার মালিক হন প্রধানমন্ত্রী ।

২. প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ নেতৃত্বঃ
            সংসদীয় সরকারের সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দক্ষ ও বলিষ্ঠ হাতে নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে । কেননা তার নেতৃত্বেই মন্ত্রীসভা শাসন ক্ষমতা বাস্তবায়ন করে । 
এবং সরকার গতিশীল ও শক্তিশালী হয় । তিনি মন্ত্রীসভা ও আইন সভার মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপন করে করে ।

৩. শক্তিশালী বিরোধী দলঃ
         বিরোধী দলের অস্তিত্ব ও শক্তিশালী অবস্থান সংসদীয় সরকারের সফলতার জন্য একটি বিশেষ পূর্ব শর্ত । কেননা বিরোধী দলের ন্যায় সংগত ও গঠনমূলক সমালোচনা ক্ষমতাসীন বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের স্বেচ্ছাচার রোধে একান্ত প্রয়োজন ।

৪. বিচার বিভাগের স্বাধীনতাঃ
         সংসদীয় সরকারের সফলতার একটি বিশেষ শর্ত হল বিচার  বিভাগের স্বাধীনতা । বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে অধ্যাপক লাস্কি বলেন,
“ঞযব রহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ঃযব লঁফরপরধৎু রং বংংবহঃরধষ ঃড় ভৎববফড়স ড়ভ লঁংঃরপব ধহফ ঢ়ধৎষরধসবঃধৎু মড়াবৎহসবহঃ ড়িৎশ নবংঃ .’’

৫. সাংবিধানিক ব্যবস্থাঃ
           সংসদীয় সরকারের সফলতার জন্য সাংবিধানিক বা আইনি ব্যবস্থা থাকতে হবে । সরকারী দল ও বিরোধী দলের সদস্যদের বেতন ভাতা সংসদে নিয়মিত উপস্থিতি, আলোচনা, অংশগ্রহণ ও স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ সম্বলিত সাংবিধানিক ও আইনি ব্যবস্থা থাকতে হবে ।  


                 
             ৮ম অধ্যায়
সংসদীয় সরকারের সাথে অন্যান্য সরকারের তুলনাঃ 


১. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের সাথে তুলনাঃ
                 রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতি প্রযোজ্য হওয়ায় শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন । এই শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীপরিষদ আইন পরিষদের নিকট দায়ী থাকে না । ফলে রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠতে পারে । 
অপরপক্ষে, সংসদীয় সরকারের শাসন ব্যবস্থা শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে পারষ্পারিক সম্পর্ক থাকার ফলে আইন বিভাগ প্রণীত আইনগুলোকে শাসন বিভাগ যথাযথ ভাবে কার্যকারি করে ।
 তাই  মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার স্বেচ্চাচারী হতে পারে না ।


২. একনায়কতন্ত্রের সাতে তুলনাঃ
            একনায়কতন্ত্র যেহেতু একজন ব্যাক্তিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সেহেতু তিনি ইচ্ছানুযায়ী শাসন কার্য পরিচালনা করতে পারেন । অপর পক্ষে সংসদীয় সরকার সাম্য,মৈত্রী ও স্বাধীনতার নীতিতে বিশ^াসী । 
এত মানুষের বুদ্ধি বৃত্তির বিকাশ ঘটে । 

৩. রাজতন্ত্রের সাতে তুলনাঃ
         রাজতন্ত্রে এমন এক ব্যাক্তিক শাসন ব্যবস্থা যেখানে রাজা বা রাণী রাষ্ট্রের সর্বোচ্য ক্ষমতার আধিকারী । অপর পক্ষে সংসদীয় সরকারকে একটি সীমিত গন্ডীরমধ্যে থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয় ।
 ফলে তিনি স্বৈরাচারী বা স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না । কাজেই এটি জনগনের জন্য কল্যাণকর ।


৪. সমাজতন্ত্রের সাথে তুলনাঃ
            সমাজতন্ত্র অনেক সময় স্বৈরাতন্ত্রে রূপ নিতে পারে । কারণ এখানে ব্যক্তিগত মতামত প্রদানের চাইতে সমাজের মতামত বেশি গ্রহণ করা হয় । কিন্তু অনেক সময় সমাজের কর্তারা নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্য বিভিন্ন খারাপ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে । অপরদিকে গণতন্ত্রে সকলের মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় বিধায় সহজে কোন খারাপ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয় না । 


  
               ৯ম অধ্যায়

সংসদীয় সরকার অন্য যেকোন সরকারের চাইতে উত্তম উক্তিটির যৌক্তিকতাঃ 
            সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা অন্যান্য শাসন ব্যবস্থা থেকে অধিক গ্রহণযোগ্য । অধ্যাপক এ্যাপলবি বলেন, “ চধৎষরধসবহঃধৎু মড়াবৎহসবহঃ রং ফবপরফবফষু নবঃঃবৎ ঃযধহ ধহু ড়ঃযবৎ মড়াবৎহসবহঃ .”  নিচে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা অন্য যে কোন সরকার ব্যবস্থার চাইতে উত্তম কেন সে বিষয়ে যুক্তি দেওয়া হলো ।

১. আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে সংযোগ সাধনঃ
                      সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় আইন ও শাসন বিভাগ একে অপরের সহযোগী হিসাবে কাজ করে  । এ ক্ষেত্রে আইন বিভাগের একাংশ নিয়ে শাসন বিভাগ গঠন করা হয় ।

২. সুপরিবর্তনীয শাসন ব্যবস্থাঃ
           মন্ত্রীপরিষদ শাসিত শাসন ব্যবস্থা সুপরিবর্তনীয় । সাধারন আইন পাশের পদ্ধতিতে সংবিধানের যে কোন ধারা উপধারা পরিবর্তন করা যায়  তাই এ শাসন ব্যবস্থা
 সুপরিবর্তনীয় বিধায় গ্রহণযোগ্যতা বেশি । 

৩. প্রতিানিধিত্বমূলক গনতান্ত্রিক ব্যবস্থাঃ
                  সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিনিধিত্ব মূলক  শাসন ব্যবস্থা । শাসক বৃন্দ জনগন কর্তৃক নির্বাচিত হন এবং তারা তাদের কার্যবলীর জন্য জনগনের নিকট জবাব দিহিতা করতে হয় । জেনিংস বলেন, ‘এড়াবৎহসবহঃ রিঃয ঁং রং মড়াবৎহসবহঃ নু ড়ঢ়রহরড়হ ধহফ ঃযধঃ রং ঃযব ড়হষু শরহফ ড়ভ ংবষভ মড়াবৎহসবহঃ রং ঢ়ড়ংংরনষব .’

৪. জনমতের প্রতিফলনঃ
          এ ব্যবস্থায় সরকার জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে । কারন জনমতকে অগ্রাহ্য করলে পরবর্তী নির্বাচনে প্রত্যাখ্যাত হবার সম্ভাবনা থাকে তাই এই ব্যবস্থাই সরকারের আইন প্রনয়ন,পরিবর্তন ও সংবিধান সকল কর্মকান্ডে জনমতের প্রতিফলন ঘটে ।

৫. সার্বভৌম আইনসভাঃ
           একমাত্র সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সার্বভৌম আইনসভা থাকে । ফলে জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আইন সভার সদস্যগণ জনগনের আশা আকাংক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে জনকল্যাণমূলক আইন প্রণয়ন করে । 
তাই এ ব্যবস্থায় দেশ উৎকৃষ্ঠ আইন পেতে পারে ।


৬. রাজনৈতিক শিক্ষা প্রসারঃ
          সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় জনগনের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটে । দেশের বিভিন্ন সমস্যা, সরকারী নীতি ও কার্যক্রম প্রভৃতি বিষয়ে আইন সভায় তর্ক ও বিতর্ক  আলোচনা হয় । ক্ষমতাশীল দলও আতেœাপক্ষ সমর্থনের মাধ্যমে জনমত সপক্ষে নিয়ে প্রয়াস চালায় ।

৭. বিরোধী দলের অবস্থানঃ
          এই শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দল আইন সভায় এবং বাহিরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । বিরোধী দল সরকারের গণবিরোধী কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ।
 এবং সরকারের কার্যনীতির প্রতি নজর রাখে । ফলে সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না ।


 উপসংহারঃ
        পরিশেষে বলা যায়, সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনায়ন পূর্বক জনগনের অংশগ্রহনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় । 

অন্যদিকে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের সমন্বয়ে শাসন কার্য পরিচালিত হয় বিধায় সংসদীয় সরকারের সফলতা  বৃদ্ধি পায় ।
 তাই বলা হয়, সংসদীয় সরকার অপরাপর সরকার থেকে উৎকৃষ্ঠতর । এ ব্যবস্থায় সরকার জনমত দ্বারা পরিচালিত, সংগঠিত 
ও নিয়ন্ত্রিত হয় । 

বর্তমান বিশে^ এই সরকার পদ্ধতি অত্যধিক জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃত ।
 

আপনি ও পছন্দ করতে পারেন